সুইচিরো হোন্ডার গল্প: ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের মহাসড়ক সুইচিরো হোন্ডা, হোন্ডা মোটরস-এর প্রতিষ্ঠাতা, এক অসাধারণ জীবনের অধিকারী ছিলেন। তাঁকে টয়োটা প্রত্যাখ্যান করেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর কারখানা ধ্বংস হয়েছিল, ভূমিকম্পে তিনি সর্বস্ব হারিয়েছিলেন। তিনি দেউলিয়া, অপমানিত এবং একেবারে ভেঙে পড়া অবস্থায় পৌঁছান। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বরং তিনি নিজের ব্যর্থতাগুলোকেই সাফল্যের জ্বালানিতে রূপান্তর করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই হোন্ডার ইঞ্জিনের প্রতি অদম্য টান ছিল। তরুণ বয়সে তিনি নতুন একটি পিস্টন ডিজাইন করেন, বিশ্বাস ছিল এটি পুরো ইঞ্জিন ইন্ডাস্ট্রিকে বদলে দেবে। কিন্তু টয়োটা তা গ্রহণ করেনি। অধিকাংশ মানুষ হয়তো এখানেই থেমে যেত, কিন্তু হোন্ডা আবার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়বারও টয়োটা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তখনও তিনি হাল ছাড়েননি। ধার করে একটি ছোট কারখানা স্থাপন করেন, যেখানে নিজেই পার্টস তৈরি শুরু করেন।
এরপর আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কারখানা দু’বার বোমায় ধ্বংস হয়। তিনি আবার সব গড়ে তোলেন। এরপর আসে ভয়াবহ ভূমিকম্প, যা সম্পূর্ণভাবে তাঁকে নিঃস্ব করে দেয়। তবুও তিনি নিজেকে দুঃখে ভাসাননি। বরং নতুন পথ খুঁজে বের করেন। যুদ্ধোত্তর জাপানে যখন মানুষ সাশ্রয়ী পরিবহনের খোঁজে ছিল, তিনি তখন একটি সাধারণ বাইসাইকেলে ছোট ইঞ্জিন লাগিয়ে মোটরবাইক তৈরি করেন। এই ছোট আইডিয়াই বদলে দেয় সবকিছু।
এই মোটরবাইক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এর থেকেই জন্ম নেয় “হোন্ডা মোটরস”—যা পরবর্তীতে বিশ্বের বৃহত্তম মোটরসাইকেল কোম্পানি এবং সফল গাড়ি প্রস্তুতকারক হয়ে ওঠে।
হোন্ডার জন্ম ১৯০৬ সালে, এক লোহারি ও সাইকেল মেরামতকারীর পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই মেকানিক্যাল যন্ত্রে তাঁর আগ্রহ ছিল। বইয়ের থেকে গিয়ার, নাট-বল্টু তাঁকে বেশি টানত। স্কুলে থাকতে একবার তিনি রাবারের সাইকেল প্যাডেল দিয়ে পরিবারের সিল তৈরি করেন, যাতে রিপোর্ট কার্ডে নিজের সই জাল করতে পারেন।
১৫ বছর বয়সে তিনি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে টোকিও যান মেকানিকের কাজ শিখতে। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি বা অর্থ না থাকলেও, শুধু ইচ্ছা আর স্বপ্ন নিয়ে তিনি অটো গ্যারেজে কাজ করতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের দক্ষতা দিয়ে তিনি নজর কাড়েন। এমনকি একসময় রেসিং কার তৈরি করে জাপানের গতির রেকর্ড ভাঙেন।
১৯৩৭ সালে তিনি নিজেই একটি ছোট কারখানা স্থাপন করেন, যেখানে পিস্টন রিং তৈরি হতো। টয়োটার কাছে তা বিক্রি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম ব্যাচে ৫০টির মধ্যে মাত্র ৩টি মানোত্তীর্ণ হয়। তিনি নিজেই বলেন, “সাফল্য মানে ৯৯% ব্যর্থতা আর ১% সফলতা।”
এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি আবার স্কুলে ভর্তি হন, মেটালার্জি (ধাতুবিজ্ঞান) নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। দিনে কারখানা চালাতেন, রাতে পড়াশোনা করতেন। দুই বছরের মাথায় তাঁর পিস্টন রিং টয়োটার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়। এরপর শুরু হয় তাঁর প্রকৃত বিজয়ের যাত্রা।
যুদ্ধ তাঁর সব কিছু শেষ করে দিয়েছিল। কারখানা বোমায় উড়ে যায়, ভূমিকম্পে যা অবশিষ্ট ছিল তাও যায়। তখন তিনি নিজের কারখানার বেঁচে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ টয়োটার কাছে বিক্রি করে নতুন করে স্বপ্ন দেখেন। ১৯৪৬ সালে একটি সামরিক জেনারেটরের ছোট ইঞ্জিন পেয়ে তিনি তা বাইসাইকেলে বসিয়ে দেন। এই ছিল তাঁর প্রথম প্রোটোটাইপ।
এই বাইকটি জনপ্রিয়তা পায় এবং ক্রমে একটি প্রকৃত মোটরসাইকেল হিসেবে রূপ নেয়। ১৯৪৮ সালে তিনি হোন্ডা মোটর কোম্পানি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ধাপে ধাপে তিনি একের পর এক উদ্ভাবন আনেন—Type A, Dream, এবং সুপার কাব, যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া যানবাহনে পরিণত হয়।
একজন প্রকৌশলী হিসেবে হোন্ডা ছিলেন দুর্দান্ত, কিন্তু ব্যবসায়িক বিষয়গুলোতে আগ্রহ কম ছিল। তাই তিনি সঙ্গে নেন তাকিও ফুজিসাওয়াকে, যিনি আর্থিক ও বিপণন দিক সামলাতেন। এই অংশীদারিত্ব হোন্ডার সাফল্যে বিশাল অবদান রাখে।
রেসিংয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কখনো থেমে যায়নি। ১৯৫৯ সালে তিনি হোন্ডাকে নিয়ে অংশগ্রহণ করেন বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন রেসিং—Isle of Man TT-তে। প্রথম দিকে সফল না হলেও, ১৯৬১ সালের মধ্যে তিনি বিশ্বজয় করেন। তাঁর মোটরসাইকেল সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
পরে আসে Honda Civic, CVCC প্রযুক্তির সাহায্যে যেটি পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি-সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। আমেরিকায় এই গাড়ি বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং হোন্ডা গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭৩ সালে হোন্ডা কোম্পানির প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর নেন। তখন হোন্ডা বিশ্বের অন্যতম বড় অটোমোবাইল ও মোটরসাইকেল নির্মাতা কোম্পানি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নতুন কিছু শেখা এবং চেষ্টা করতে কখনো থেমে যাননি।
সুইচিরো হোন্ডার জীবন আমাদের শেখায়—
- ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়, বরং শেখার শুরু।
- স্বপ্ন ও সংকল্প থাকলে প্রতিকূলতাও পেছনে পড়ে যায়।
- মানুষের প্রয়োজন বুঝে উদ্ভাবন করলে সাফল্য আসবেই।
- নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে সঠিক টিম তৈরি করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আপনিও যদি এখনো সংগ্রামে থাকেন, মনে রাখবেন—যে মানুষটির নাম আজ কোটি কোটি ইঞ্জিনে লেখা, তিনি একদিন ছিলেন নিঃস্ব, প্রত্যাখ্যাত, এবং ব্যর্থ। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। এবং সেই জেদই তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।
**আপনার স্বপ্নও বাস্তব হতে পারে—শুধু আপনাকে হোন্ডার মতো এগিয়ে যেতে হবে।**
লেখক-
মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম চৌধুরী
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার; খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ক গবেষক
আরো পড়ুন: কেন আয়ুর্বেদ পিছিয়ে পড়ল, আর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এত এগিয়ে গেল?